ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞে গাজাকে আর চেনার উপায় নেই
প্রথম আলো
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর, ২০২৪ এ ০১:৩৩
স্যাটেলাইটে তোলা আগের ও পরের ছবিতে এক বছরের যুদ্ধে গাজায় বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার নগর গাজা এক বছর আগে যেমন ছিল, তার সঙ্গে এই গাজার মিল খুব সামান্যই পাওয়া যায়।
ইসরায়েলের হামলায় গাজার জনবসতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মুছে ফেলা হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ ও গির্জা। ধ্বংস হয়েছে করা গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজমি।
মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের (১৪১ বর্গমাইল) ছোট্ট ভূখণ্ডটিতে ধ্বংসের মাত্রা এতটাই তীব্র যে অনেক বাসিন্দা নিজেদের বাড়িতে এখনই ফিরতে পারবেন না এবং সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেও সক্ষম হবেন না।
আল–জাজিরার ডিজিটাল ইনভেস্টিগেশন দল ‘সানাদ’–এর কাছ থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট ছবিতে গর্তে ভরা ভূখণ্ড, ঝলসে যাওয়া কৃষিজমি ও মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে।
উত্তর গাজা থেকে (সর্ব দক্ষিণের) শহর রাফা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন ছড়িয়ে আছে।
শরণার্থীশিবিরে হামলা
গাজা উপত্যকায় বড় যে আটটি শরণার্থীশিবির রয়েছে, তার একটি জাবালিয়া। শরণার্থীশিবিরটি উত্তর গাজায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কারণে সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি গৃহহীন হলে ১৯৪৮ সালে এই শরণার্থীশিবির গড়ে তোলা হয়।
জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের আয়তন দেড় বর্গকিলোমিটারেরও কম। গাজার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি এটি।
শরণার্থীশিবিরটিতে ১ লাখ ১৬ হাজারের মতো নিবন্ধিত শরণার্থী বাস করেন। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল বারবার এই শরণার্থীশিবিরে হামলা চালিয়েছে। হত্যা করেছে শতাধিক মানুষকে। হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বোমাও ব্যবহার করা হয়েছে।
আকারে সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক বিধ্বংসী বোমাগুলো একটি এটি। এই বোমার আঘাতে ৪০ ফুটের বেশি বড় গর্তের সৃষ্টি হতে পারে।
জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের খুব বেশি কিছু এখন আর অবশিষ্ট নেই।
মসজিদ ও গির্জায় হামলা
জাবালিয়া থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে গাজার ওল্ড সিটি। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নগরগুলোর একটি এটি। ওল্ড সিটিতে পঞ্চম শতাব্দীর নানা নিদর্শন চোখে পড়তে।
ওল্ড সিটিতে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর মধ্যে কয়েকটি মসজিদ ও গির্জা অন্যতম। সেগুলোর একটি দ্য গ্রেট ওমরি মসজিদ। এটি গাজার গ্রেট মসজিদ নামেও পরিচিত। এ ছাড়া গাজার দুই বিখ্যাত গির্জা—সেন্ট ফিলিপ দ্য ইভানজেলিস্ট চ্যাপেল ও দ্য চার্চ অব সেন্ট প্রফিরিয়াস।
গত বছর ৮ ডিসেম্বর ইসরায়েলের হামলায় গ্রেট ওমরি মসজিদ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে থাকা ৭৪৭ বছরের পুরোনো পাঠাগার, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের পুরোনো কপিসহ দুর্লভ সব পাণ্ডুলিপি—সবই হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজা সরকারের মিডিয়া অফিস থেকে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৬১১টি মসজিদ সম্পূর্ণ ও ২১৪টি আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজায় যে তিনটি গির্জা আছে, সেগুলোতেও ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে।
স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা
ওল্ড সিটি থেকে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজার (আইইউজি) দূরত্ব খুব বেশি নয়। গাজা উপত্যকার শীর্ষ দুই বিশ্ববিদ্যালয় আইইউজি ও আল-আজহার ইউনিভার্সিটি। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতেন।
আগেও অন্যান্য যুদ্ধে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এবারের যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির ক্যাম্পাস পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
জেনেভাভিত্তিক স্বাধীন সংগঠন ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর থেকে বলা হয়েছে, ইসরায়েল খুবই পরিকল্পিতভাবে গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছে। গাজায় মোট ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়, সেগুলোর কোনোটি আর অক্ষত নেই।
হাসপাতালে হামলা
গাজার সর্ববৃহৎ হাসপাতাল আল-শিফা। ইসরায়েল গাজার যেসব হাসপাতালে সবার আগে হামলা চালায়, আল-শিফা তার একটি। গত বছর ১৫ নভেম্বর গাজায় হামলা শুরুর মাত্র দেড় মাসের মাথায় ইসরায়েলি সেনারা আল-শিফা হাসপাতাল ঘিরে ফেলেন। সেখানে ওই সময় কয়েক হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাঁচ মাস পর এ বছরের এপ্রিলে ইসরায়েলি সেনারা দ্বিতীয়বার দুই সপ্তাহ আল-শিফা হাসপাতাল অবরুদ্ধ করে রাখেন। পুরো হাসপাতাল ধ্বংস করা হয়, হত্যা করা হয় কয়েক শ মানুষকে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীন হাসপাতালে হামলা যুদ্ধাপরাধ। বিশেষ করে ওই সব হাসপাতালে, যেখানে গুরুতর অসুস্থ রোগী ও শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
গাজায় গত এক বছর অন্তত ১১৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক হামলার কারণে অচল হয়ে গেছে। সেখানে অনেক মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য জরুরি চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
কৃষিজমি ধ্বংস
গাজার মধ্যাঞ্চলের একেবারে দক্ষিণে দেইর আল-বালাহ। গাজার যেসব এলাকা কৃষিকাজের জন্য বিখ্যাত, দেইর আল-বালাহ তার একটি। অঞ্চলটি কমলা, জলপাই এবং অবশ্যই খেজুর উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।
স্যাটেলাইটের ছবিতে দেইর আল-বালাহর মাঘাজিতে কৃষি খামার, রাস্তা ও বাড়িঘর ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে।
আল–জাজিরার দল সানাদ স্যাটেলাইটে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে বলেছে, গাজার অর্ধেকের বেশি (৬০ শতাংশ) কৃষিজমি ইসরায়েলের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার বাসিন্দাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্য এ কৃষিজমির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাজার ৯৬ শতাংশ বাসিন্দার খাদ্যনিরাপত্তা নেই।
২০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা
গত বছরের ১৩ অক্টোবর স্থলাভিযান শুরুর আগে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গাজা সিটি ও গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের সব বাসিন্দাকে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
সে মুহূর্তে গাজা সম্পূর্ণ অবরোধের সপ্তম দিন ছিল। তখন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ‘কোনো বিদ্যুৎ নয়, খাবার নয়, পানি নয়, গ্যাস নয়—সবকিছু গাজায় বন্ধ’ রাখার কথা বলেছিলেন।
সে সময়ে গাজার ৮০ শতাংশ অঞ্চলই ফিলিস্তিনিদের জন্য অনিরাপদ বলা হয়। সেই অঞ্চলগুলোকে হয় ইসরায়েলি বাহিনী ‘নো-গো জোন’ ঘোষণা করেছিল নতুবা ফিলিস্তিনিদের এলাকা খালি করে দিতে বলেছিল। অল্প কিছু মানবিক অঞ্চল ছিল অনেক ফিলিস্তিনির শেষ আশ্রয়। যদিও পরে ওই সব মানবিক অঞ্চলেও হামলা করে ইসরায়েল।
নিরাপত্তার খোঁজে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আল-মাওয়াসিতে আশ্রয় নিয়েছেন। আল-মাওয়াসি গাজা উপকূল বরাবর ছোট্ট একটি বেলাভূমি। ইসরায়েল সেটিকে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা করেছিল। তা সত্ত্বেও সেখানে হামলা চালানো হয়েছে। কয়েক শ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অনেকে। আল-মাওয়াসির হামলা দেখিয়েছে, গাজায় আসলে নিরাপদ ভূখণ্ড বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ
মাত্র এক বছরের যুদ্ধে গাজার ভূচিত্র বদলে প্রায় অচেনা হয়ে গেছে।
সেন্টিনেল-১ রাডার ডেটা থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইসরায়েলের হামলায় গাজা ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
এর মধ্যে রয়েছে উত্তর গাজার ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ, গাজা সিটির ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ, দেইর আল-বালাহর ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ, খান ইউনিসের ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ, রাফার ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
গত এক বছরে প্রায় ৭৫ হাজার টন বিস্ফোরক গাজায় ফেলা হয়েছে। যুদ্ধে গাজায় ৪ কোটি ২০ লাখ টনের বেশি ধ্বংসস্তূপ জমা হয়েছে। এ ধ্বংসস্তূপ সরাতেই কয়েক বছর সময় লেগে যাবে বলে আভাস বিশ্লেষকদের। সেখানে অনেক বোমা অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে আছে।
গাজায় এক বছরের যুদ্ধে ৪১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন ইসরায়েলি সেনারা। আহত হয়েছেন আরও প্রায় এক লাখ মানুষ। সেখানে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। অনাহারেও অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন।