ছাত্রজনতার নামে ঐতিহ্যবাহী হজরতপুর হাট দখল-লুটপাট
কালবেলা
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর, ২০২৪ এ ০১:১১
ঢাকার কেরানীগঞ্জে সুষ্ঠু তদারকির নামে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয় ব্যবহার করে প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের গরুর হাট দখল করে লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে একটি সঙ্গবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে।
হাট সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ঢাকা জেলার সব চেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী হজরতপুর গবাদিপশুর হাট গত ৫ আগস্টের পর ছাত্র জনতার নাম করে ইজারাদারদের হটিয়ে দখলে নেয় স্থানীয় একটি মহল।
প্রথম দিকে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠলেও এখন হাট চলছে হাসিল যার টাকা তার নীতিতে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে রশিদ বানিয়ে যে যেভাবে পারছে টাকা তুলে পকেট ভরছে। ফলে প্রতিবছর সরকারের কোষাগারে জমা হওয়া ৫-৭ কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। আর এর পেছনে হজরতপুর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নুরুল আলম তালুকদার, একই কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ও সমন্বয়ক দাবিদার ছহিব মোল্লাহ এবং তাদের এক রাজনৈতিক প্রশ্রয় দাতার নাম এখন আলোচনার তুঙ্গে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হাটের নিয়ন্ত্রণ ছাত্র-শিক্ষকদের হাতে থাকার কথা থাকলেও দিন শেষে অধিকাংশ ছাত্ররা পাচ্ছে না শ্রমের মজুরীও। তাদের অভিযোগ হযরতপুর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নুরুল আলম তালুকদার ছাত্রদের নিয়ে টাকা উঠালেও দিন শেষ বিশেষ কলেজ ছাত্র ছহিব মোল্লাসহ কিছু শিক্ষার্থী ছাড়া টাকা পান না ছাত্ররা। ছাত্রদের পোশাক আর আইডি কার্ড ব্যবহার করে সুবিধা নিচ্ছে ছহিব মোল্লাহ, বৌনাকান্দী গ্রামের ইয়াসিন, আলী, বাবু, রাকিব, দিলিপ, হাকিম, বাটারাকান্দির উজ্জ্বল, শিক্ষক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম, মালেক, শহিদ, মিঠুন, সাদ্দাম, সাজ্জাত হোসেন মনির, শাহারিয়ার কবির, অহিদুল হক খোকা, শোভনসহ নামধারী প্রায় শতাধিক ছাত্রজনতা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হযরতপুর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কলাতিয়া ডিগ্রি কলেজ, সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড ঝুলিয়ে হাটের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় ছাত্র যুবকরা। কেউ হাসিল আদায় করছেন, কেউ লাঠি হাতে পশুর লাইন ঠিক করছেন, হাসিল রশিদ চেক করছেন, বিভিন্ন পয়েন্টে পাহারার দায়িত্ব সামলাচ্ছে। এ সময় ছাত্র ও সাবেক ছাত্রদের পাশাপাশি তাদের শিক্ষকদের দেখা গেছে হিসাব তদারকীর দায়িত্বে। বিশেষ করে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তালুকদারের নেতৃত্বেই হাটের লাখ লাখ টাকা লুট হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে।
সাপ্তাহিক হাট শনিবার কম বেশি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ইজারা আদায় করা হলেও সরকারি খাতে জমা হচ্ছে সামান্য টাকা। তবে গেলো চার সপ্তাহ একটি টাকাও জমা হয়নি সরকারি কোষাগারে।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে আসা গরু ব্যবসায়ী আব্দুল হক ব্যাপারী জানান, হাটে কোন শৃঙ্খলা নেই। সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ না থাকায় কারো কোন কথা বা নির্দেশনা মানে না হাসিলদার, নিরাপত্তাকর্মী ও সেচ্ছাসেবীরা। যে যার মত হাসিল আদায় করে গরু-ছাগল বিক্রির টাকা পকেটে ঢুকাচ্ছে। ১০ হাজার টাকার হাসিল মাত্র এক হাজার টাকায় আবার কখনো কখনো এক হাসিল একাধিকবার করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। আর হাটের সময় শেষে ফিরতি স্লিপ নিতেও অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
রোহিতপুর থেকে আসা কৃষক ফজলুর রহমান জানান, ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় একটি গাভী কিনে সঙ্গে সঙ্গেই হাসিল আদায় করেছেন কিন্তু গেটে তাকে আটকে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এক ঘণ্টা ধরে তাকে হয়রানি করে অন্যের মধ্যস্থতায় গরু নিয়ে ফিরেছেন।
এছাড়াও হাটে আসা সচেতন মহল মনে করছেন এভাবে চলতে থাকলে হয়তো খুব শীগ্রই ঐতিহ্য হারাবে ঢাকা তথা দেশের অন্যতম গবাদিপশুর হাট হযরতপুর পশু হাট। তাছাড়া ছাত্রজনতার নামে এভাবে বিশৃঙ্খলা, লুটপাট সাধারণ মানুষের কাছে ২০২৪ এর নতুন বাংলাদেশ এবং ছাত্রসমাজকে সমাজে ছোট করবে।
অভিযুক্ত শিক্ষক তালুকদারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি। তবে আরেক শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রথমে আমরা শৃঙ্খলা রক্ষার্থে হাটে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে খরচের পর বাকি টাকা ইউএনও অফিসে জমা দিয়েছি। এখন হাট নিয়ন্ত্রণে বাহিরে চলে যাওয়ায় আর হাটে যাই না। আর কলেজের নামা টাকা রাখার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে তিনি বলেন, কোন ছাত্র বা নেতা কলেজ ফান্ডে কোনো টাকা জমা দেয়নি।
অভিযুক্ত ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয়দানকারী ছহিব মোল্লাহ বলেন, সমন্বয়করা দেশ চালাচ্ছে কারো অনুমতি ছাড়া আর আমরা হাট চালাতে কার অনুমতি নিবো? যেভাবে দেশের বিভিন্ন হাট চালাচ্ছে ছাত্ররা আমরাও একইভাবে চালাচ্ছি।
কেরানীগঞ্জ মডেল উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের অভিভাবক আমান উল্লাহ আমান আমাদেরকে এই হাট থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তাই বিএনপির কোনো নেতাকর্মী এই হাটে আসে না। তবে জানতে পেরেছি পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ছাত্র পরিচয়ে এইসব অপকর্ম করছে। দ্রুত এই হাটের পুন: ইজারার ব্যবস্থা করার জন্য কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিনাত ফৌজিয়া বলেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বর বর্তমান ইজারাদারের ইজারার টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও পরিশোধ না করায় আমরা ইজারা বাতিল করেছি। খাস আদায় কমিটির মিটিং শেষে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং পরবর্তী ইজারাদা না হওয়া পর্যন্ত তারাই ইজারা আদায় করবে। তবে ছাত্রদের ব্যানারে ইজারা আদায়ের ব্যাপারটি তিনি জানেন না বলেও জানান।